প্রথম আলো পত্রিকায় ১৩ জুন তারিখে প্রকাশিত
বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নে অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা অব্যাহত রাখতে চাইলে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে শ্রম অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে ২৮ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নে সাময়িকভাবে স্থগিত হতে পারে অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা (জিএসপি)।
আজ জেনেভায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর বার্ষিক সম্মেলনে (আইএলসি) বাংলাদেশের সময়ভিত্তিক সংস্কারের পথরেখা নিয়ে আলোচনার কথা রয়েছে। ব্রাসেলসের একটি কূটনৈতিক সূত্র গত সপ্তাহে প্রথম আলোকে জানিয়েছে, গত ৩১ মে বাংলাদেশকে পাঠানো চিঠিতে জিএসপি বজায় রাখার স্বার্থে শ্রম অধিকার সমুন্নত রাখার তাগিদ দিয়েছে ইইউ। তারা আইএলসিতে বাংলাদেশের কাছে সময়সীমাভিত্তিক পদক্ষেপের বিস্তারিত জানতে চায়।
জেনেভায় বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে কর্মরত কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের জুনে আইএলওর বার্ষিক সম্মেলন আইএলসিতে বাংলাদেশের শ্রম অধিকার সুরক্ষার জন্য একটি অনুচ্ছেদ যুক্ত হয়। এরপর সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখতে আইএলওর একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে। আজ মঙ্গলবার আইএলসিতে বিশেষ অনুচ্ছেদ নিয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটিতে যে আলোচনা হবে, সেখানে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের পথরেখা তুলে ধরা হবে।
২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের কর্মপরিবেশ, শ্রমমানের উন্নতির জন্য গৃহীত উদ্যোগ কমপ্যাক্টে শ্রম পরিস্থিতি দেখভাল ও উন্নতির লক্ষ্যে করণীয় সুপারিশ তুলে ধরার দায়িত্ব দেওয়া হয় আইএলওকে। আইএলওর সনদগুলো মানার বিধান অনুসরণসাপেক্ষেই ইইউ জিএসপি-সুবিধা দেয়। তাই ইউরোপের বাজারে জিএসপি ধরে রাখতে হলে আইএলওর সুপারিশ মেনে চলাটা জরুরি।
গত বছর আন্তর্জাতিক লেবার কনফারেন্সে (আইএলসি) গৃহীত বাংলাদেশ-সম্পর্কিত বিশেষ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সংগঠন করা এবং শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপের ঘাটতি ও ব্যর্থতা অত্যন্ত উদ্বেগের। এ ক্ষেত্রে শ্রম আইন, ২০১৩তে সংশোধনী আনা, ইপিজেড আইনে সংগঠিত হওয়ার অধিকার পুরোপুরি নিশ্চিত করা, ট্রেড ইউনিয়নবিরোধী বৈষম্যের তদন্ত করা এবং ইউনিয়নের নিবন্ধন স্বচ্ছতা ও দ্রুততার সঙ্গে করার মতো চারটি প্রসঙ্গ ওই অনুচ্ছেদে এসেছে।
জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত সপ্তাহে প্রথম আলোকে বলেন, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারসহ শ্রমিকদের সব ধরনের অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো আইএলসিতে তুলে ধরা হবে। এ ছাড়া আইএলওর বিশেষ অনুচ্ছেদে দেওয়া সুপারিশ কবে, কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তা-ও জানানো হবে। আনিসুল হক আইএলসিতে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেবেন এবং এ জন্য তিনি শনিবার জেনেভায় গেছেন।
ইউরোপীয় কমিশনের বাণিজ্যবিষয়ক মহাপরিচালকের দপ্তরের পরিচালক, কর্মসংস্থানবিষয়ক মহাপরিচালকের দপ্তরের পরিচালক এবং বহিঃসম্পর্ক বিভাগের মানবাধিকার, বৈশ্বিক ও বহুপক্ষীয়বিষয়ক মহাপরিচালক গত ৩১ মে পররাষ্ট্র, বাণিজ্য এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিবকে চিঠি লেখেন।
ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, কমপ্যাক্টের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতি এবং কারখানার নিরাপত্তা ও শ্রমবিষয়ক কাঠামোর ক্ষেত্রে উন্নতি প্রশংসনীয়। তবে কমপ্যাক্টের বৈঠক শেষে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে যে কমপ্যাক্ট বাস্তবায়নে গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের অঙ্গীকারের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে যথেষ্ট নয়। আইএলসির আগে আইএলওর সুপারিশ অনুযায়ী সংগঠন করা এবং যৌথ দর-কষাকষির অধিকার নিশ্চিত করতে আরও অনেক পদক্ষেপ নিতে হবে। এই পরিস্থিতিতে আইএলসির ১০৬তম অধিবেশন সামনে রেখে আইএলওর প্রতিটি সুপারিশ অনুযায়ী সময়সীমাভিত্তিক কৌশল কী হবে, সেটি তুলে ধরা বাংলাদেশের জন্য জরুরি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাবেক বাণিজ্য উপদেষ্টা জিল্লুল হাই রাজী গত সোমবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, শ্রম অধিকার নিয়ে প্রশ্ন থাকায় ইইউর জিএসপি সাময়িকভাবে স্থগিত হওয়ার শঙ্কাটা অমূলক নয়। কারণ ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে চালু হওয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন আইনে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে শর্তযুক্তভাবে জিএসপি দেওয়া হচ্ছে।
তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান গত সোমবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন সংশোধন করে এটি বাস্তবায়নে ২০১৬ সালে বিধিমালা জারি করা হয়েছে। শ্রম অধিকার নিশ্চিত করতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো চলমান প্রক্রিয়া। তাই এসব বাস্তবায়নে কিছু সময় দরকার।
এর আগে সরকার রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ আইন সংশোধন করে মন্ত্রিসভার অনুমোদন সাপেক্ষে সংসদে জমা দেওয়ার পর এটিকে প্রত্যাহার করে নেয় অধিক পর্যালোচনার জন্য।
বেপজা আইন ও বাংলাদেশ শ্রম আইনের ধারা একই রকম হবে কি না, জানতে জেনেভায় বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের মিনিস্টার মোস্তফা আবিদ খান গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, লিখিত বক্তব্যে গতকাল যা বলা হয়েছে, সেই অনুযায়ী মঙ্গলবারের আলোচনায় বিস্তারিত বক্তব্য তুলে ধরা হবে।
বাংলাদেশ আইএলওর গভর্নিং বডির ডেপুটি মেম্বার নির্বাচিত
বার্তা সংস্থা বাসস জানায়, পাকিস্তানকে হারিয়ে আইএলওর গভর্নিং বডির ডেপুটি মেম্বার নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল সোমবার জেনেভায় অনুষ্ঠিত আইএলওর চলমান সম্মেলনে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের সাব-কমিটিতে তিনটি দেশ অংশ নেয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ১৯০টি ভোট পেয়ে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের গভর্নিং বডির মেম্বার নির্বাচিত হয় বলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা জানান। নেপাল ১৭৩ ও পাকিস্তান ১৫০ ভোট পায়।