Published in দৈনিক সমকাল on Tuesday, 3 January 2017
বাংলাদেশের অর্থবছর শুরু হয় জুলাইয়ের প্রথম দিনে। কিন্তু বছরের সালতামামি কিংবা নতুন বছরের প্রত্যাশার প্রকাশ ঘটে জানুয়ারির প্রথম দিনকে ঘিরে। গত বছরটি অর্থাৎ ২০১৬ সাল কেমন গেল_ এ প্রশ্ন বহুল আলোচিত। সামষ্টিক বা ম্যাক্রো অর্থনীতি নিয়ে যাদের ভাবনা-চিন্তা করতে হয়, তারা বলবেন_ মোটামুটি ভালোই কেটেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ছিল। বাড়িভাড়া নিয়ে শহরবাসীর উদ্বেগ থাকলেও বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য কিনতে পেরেছে সব শ্রেণির মানুষ। বলা যায়, সাধ্যের মধ্যেই ছিল জীবনযাত্রার ব্যয়। জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে পণ্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয় অনেকটা নির্ভরশীল। নতুন বছরে সরকার তেলের দাম আরও খানিকটা কমাবে_ এমন ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এর পরিমাণ যদি উল্লেখযোগ্য হয়, তাহলে জনজীবনে স্বস্তি আরও খানিকটা বাড়বে। তবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কিছুটা বাড়ার প্রবণতা রয়েছে। তেলের রফতানিকারক দেশগুলো এ বিষয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। কিন্তু তেলের দামে বড় পরিবর্তন নাও হতে পারে। অতএব, আমাদের মতো তেল আমদানিকারক দেশগুলো আপাতত নিশ্চিত থাকবে। আমি অবশ্য এ সুযোগে একটি প্রত্যাশা ব্যক্ত করে রাখছি_ জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের জন্য একটি কাঠামো তৈরি করা হোক, একটি উপযুক্ত সংস্থা থাকুক_ যারা বিশ্ববাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের বাজারের জন্য মূল্য স্থির করবে।
এ বছর বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ সন্তোষজনক পর্যায়ে ছিল। রফতানি নিয়ে উদ্বেগ সময়ে সময়ে প্রকাশ পেলেও আমদানি পরিস্থিতি ভালো ছিল। বিশ্ববাজার দেশের বাজারের মতোই স্থিতিশীল ছিল।
সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা থাকায় ব্যাংক ঋণের সুদহার কমিয়ে আনার অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করছে। এ ধরনের পদক্ষেপ উদ্যোক্তাদের জন্য প্রত্যাশিত। বড় বড় উদ্যোগে কিছুটা প্রকাশও ঘটছে। কিন্তু ক্ষুদ্র উদ্যোগ ও বাণিজ্যের জন্য সুদহার ডাবল ডিজিট অর্থাৎ ১০ শতাংশের ওপরেই রয়েছে। এ পার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে। সংবাদপত্রে দেখেছি, ব্যাংকিং খাতে মুনাফা সন্তোষজনক পর্যায়ে রয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি ঋণের বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
টাকা ও মার্কিন ডলারের মূল্যমান নিয়েও বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে ভাবতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ডলারের দাম কিছুটা বেশিই রয়েছে এবং এর পেছনে কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ। এ কারণে ডলারের মূল্য কমে যাওয়ার কারণে রফতানি বাণিজ্য ও রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে যে সুবিধা আমাদের সামনে রয়েছে, তার পুরোপুরি ব্যবহার সম্ভব হয়নি।
রফতানি বাণিজ্যে আমরা বিদায়ী বছরে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে। গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলা রফতানি বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলবে_ এমন শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। সম্মিলিত চেষ্টায় আমরা এ উদ্বেগ কিছুটা হলেও প্রশমিত রাখতে পেরেছি। তবে নতুন বছরে শঙ্কা রয়েছে দুটি কারণে_ যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিচ্ছেন আগামী ২০ জানুয়ারি। আর এ বছরেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের সরে দাঁড়ানোর কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে পেঁৗছাবে। এ দুটি দেশ সংরক্ষণবাদী বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সংরক্ষণবাদী নীতি অনুসরণ করতে থাকলে তার নেতিবাচক প্রভাব আমাদের রফতানি বাণিজ্যে পড়তেই পারে।
বাংলাদেশ সরকারের কয়েকটি অগ্রাধিকার প্রকল্প রয়েছে, যাতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। যেমন_ পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। এগুলো রাতারাতি সম্পন্ন হবে, এমন আশা করা যায় না। তবে কয়েকটির কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। এ ধরনের প্রকল্পে বিনিয়োগের কারণে অর্থনীতির অন্যান্য শাখাতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। উদ্যোক্তারা আশ্বস্ত হয়। এটা স্বস্তির কথা যে, অর্থনীতির বিভিন্ন শাখায় পুনর্বিনিয়োগ হচ্ছে। বিদেশি উদ্যোক্তারাও এটা করছেন। চীন, জাপান ও ভারত বাংলাদেশে বড় ধরনের বিনিয়োগের আশ্বাস দিয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চীনের বিভিন্ন প্রস্তাব। গত বছর চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরকালে সরকারি ও বেসরকারি খাতে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব করেছেন। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টও বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। এ প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশ সহজ শর্তে বর্ধিত ঋণ পাবে, এ প্রতিশ্রুতি মিলেছে। এখন আমাদের দায়িত্ব অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা, যাতে বিদেশি বিনিয়োগ দ্রুত আসতে পারে। বিশেষায়িত অর্থনৈতিক এলাকা বা এসইজেডের কাজেও কিছু অগ্রগতি রয়েছে। ইতিমধ্যে সরকারি উদ্যোগে পাঁচটি এলাকায় অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। বেসরকারি খাতেও দু’তিনটির কাজ চলছে। এ ধারা বজায় থাকলে শিল্প খাতের পরিস্থিতি উন্নত হবে, তাতে সন্দেহ নেই।
কর্মসংস্থানের চিত্র কিন্তু উদ্বেগজনকই রয়েছে। বিশেষ করে উদ্বেগ প্রকাশ পাচ্ছে শিক্ষিতদের কাজ পাওয়া নিয়ে। শিল্প-বাণিজ্যে প্রচুর বিনিয়োগ হলেই কেবল এ চিত্রের পরিস্থিতি পাল্টাতে পারে। প্রবাসে লোক বেশি যাচ্ছে, এটা সুলক্ষণ। নারী শ্রমিকও বেশি যাচ্ছে। তবে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ তেলের মূল্য সীমিত পর্যায়ে থাকার কারণে নিজেদের অর্থনীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তার প্রভাব বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে কর্মী নিয়োগ এবং তাদের বেতন-ভাতা প্রদানের ওপরেও পড়ছে। প্রবাসী কর্মীদের কাজের পরিবেশ, মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা, মানবাধিকার ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে আরও উদ্যোগী হতে হবে।
চলতি অর্থবছরের জন্য সরকার তিন লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে। আমাদের অর্থনীতির যে শক্তি তাতে বাজেটের আকার আরও বড় হতে পারে। কিন্তু এ জন্য চাই রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি। এটাও লক্ষণীয়, সরকার বৈদেশিক ঋণের পরিবর্তে নিজস্ব অর্থে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশি মনোযোগী হয়েছে। গত বছরে রাজস্ব আয় বাড়াতে কিছু ভালো উদ্যোগ আমরা দেখেছি এবং তার সুফলও মিলছে। তবে বাংলাদেশে জিডিপি ও বিনিয়োগ এবং জিডিপি ও রাজস্ব আদায়ের অনুপাত এখন পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান প্রধান অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশের তুলনায় যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে। রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির হারে নতুন গতি এনেই কেবল আমরা এ সমস্যার সমাধান করতে পারি।
রাজস্ব আয় বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারকে ব্যয়ের গুণগত মান বাড়ানোর প্রতিও বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ সময়মতো শেষ হয় না, এমন খবর নিয়মিত প্রকাশ হয় সংবাদপত্রে। একই ধরনের প্রকল্পের ব্যয় বাংলাদেশে প্রতিবেশী ভারত কিংবা পাকিস্তান বা শ্রীলংকার তুলনায় বেশি পড়ছে। এর সমাধানে চাই একাধিক উদ্যোগ_ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের নিবিড় মনিটরিং এবং দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব। প্রশাসনিক শিথিলতা, গাফিলতি দূর করাও গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতাও যথেষ্ট। সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের বোঝা বাড়ছে। জনগণের অর্থে সোনালী-জনতা-অগ্রণী ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখার কাজ দেখছি বছরের পর বছর। অন্যদিকে, বেসরকারি কিছু ব্যাংকেও সমস্যা রয়েছে। পারফরম্যান্স মানসম্পন্ন না হওয়া এবং অন্যান্য সমস্যার কারণে কোনো কোনো বেসরকারি ব্যাংক একীভূত করার বিষয়টি বিবেচনার সময়ও এসেছে বলে মনে করি। এখন বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকদের জমা ৮ লাখ কোটি টাকার মতো। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এটা বড় সম্পদ এবং এর যথাযথ ব্যবহার করায় চাই বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। সরকারি শিল্প বাণিজ্যের করপোরেশনগুলো নিয়েও ভাবার সময় এসেছে। এসব প্রতিষ্ঠান মাথাভারি। কোনো কোনোটির অবস্থা শোচনীয়।
অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন থেকে আমরা বলতে পারি, অনেক সূচক ইতিবাচক ও আশাব্যঞ্জক। আবার কিছু ক্ষেত্রে মেদ জন্মেছে, যাকে বলা যায় ফ্যাটম্যান সিনড্রোম। একে ছেঁটে ফেলতে হবে এবং বেশি দেরি না করেই। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে বলব খেলাপি ঋণের সমস্যার কথা। এ জন্য উপযুক্ত আইন চাই। তবে খেয়াল রাখতে হবে, বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয়। দেউলিয়া আইন নিয়েও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
পোশাক শিল্প নিয়ে নিয়মিতই আমরা উদ্বেগ দেখতে পাই। তবে এটাও ঠিক যে, এ শিল্প অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে পারছে। বিশ্ববাজারে আমাদের অবস্থান যথেষ্ট মজবুত। কিন্তু যেসব সমস্যা চিহ্নিত হয়ে আছে তা আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। বিদেশি ক্রেতাদের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান ও কাজের পরিবেশ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সম্প্রতি শ্রমিকরা বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিও জোরেশোরে তুলছে। তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়েও ভাবতে হবে। বাসস্থান ও যাতায়াত সমস্যাও প্রকট। চামড়া শিল্পকে বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এটাও ঠিক যে, বহু সুবিধা দিয়েও হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তর করার কাজ সম্পন্ন করা যায়নি। এ শিল্প বিকাশের জন্য সরকার নতুন কিছু সুবিধা দিতেই পারে। তবে তা হতে হবে নতুন এলাকায় সব শিল্প স্থানান্তর হওয়ার পরেই। চামড়া ও অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে পরিবেশগত সমস্যাও জড়িত। আমাদের রাজধানীর আশপাশের এবং আরও কিছু নদ-নদীর পানি দূষণের জন্য শিল্প কারখানার বর্জ্য দায়ী_ এটাই বাস্তব। এ সমস্যা সমাধানে শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদেরই মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে।
বিশ্ব পরিস্থিতিও আমাদের মনে রাখা চাই। ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের কথা আগেই বলেছি। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট যদি উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সংরক্ষণবাদী মনোভাবে গ্রহণ করেন, তার প্রভাব পড়তে পারে আমাদের পোশাক শিল্পে। বিশ্বে কোথায় কে কী ভাবছে, নতুন কী নীতি নিচ্ছে, কোথায় সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে, কোথায় শঙ্কা তৈরি হতে পারে_ এসব নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইকে গবেষণার ওপর জোর দিতে বলেছেন। এটা সময়ের দাবি। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও এ ধরনের পদক্ষেপ জরুরি।
নতুন বছরে আমরা আরও ভালো প্রত্যাশা করতেই পারি এবং তার বাস্তব ভিত্তি রয়েছে। কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে এবং এর কোনো কোনোটি গুরুতর। নিরাপত্তা নিয়েও দুশ্চিন্তা থাকবে। সন্ত্রাসবাদ আমরা চাই না; কিন্তু সন্ত্রাসীরা তাতেই থেমে থাকবে না। আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতেই হবে। বাংলাদেশ নিরাপদ_ আন্তর্জাতিক মহল বিশেষ করে বিনিয়োগকারীরা এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে চায়। দেশীয় উদ্যোক্তারাও এটাই চায়। আমরা নিশ্চয়ই এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারব।